জামাতের গডফাদাররা সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইর


জামাতের গডফাদাররা
সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইগত পাঁচ বছর ক্ষমতাসীন চারদলীয় জোট সরকারের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী একটি ধর্মীয় আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দল এবং এর নেতা-কর্মীরা সন্ত্রাস-দুর্নীতিতে জড়িত নন বলে তারা দাবি করে থাকেন। গত পনের বছর পর পর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় এবং বহু সংখ্যক স্থানীয় নেতাকে দুর্নীতি-চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে যৌথ বাহিনী গ্রেফতার করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার জরুরি আইনে শাসন চালিয়ে দুর্নীতি-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে তাতে জামায়াতের কেউ এখনো ধরা না পড়ায় মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর হয়ে খুন-জখমে লিপ্ত এই দলটি শদুব্দ বলে দাবি করার সুযোগও পাচ্ছে। কিন্তু ফ্রিডম সিলেটের তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, জামায়াতের চার জন সাবেক সংসদ সদস্য ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর গা-ঢাকা দিয়েছেন। তাদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তাদের পলাতক হওয়ার কারণ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ‘গডফাদারদের’ চেয়ে ক্ষমতায় থাকা জামায়াতি ‘গডফাদারদের’ সন্ত্রাসের চিত্র কোনো অংশে কম ভয়াবহ নয়। তারা প্রত্যেকেই নিজ এলাকায় কায়েম করেছিলেন একচ্ছত্র রাজত্ব ও কার্যত জামায়াতি শাসন। গড়ে তুলেছিলেন ভয়ঙ্কর সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী। বিরোধী শিবিরের ওপর চালিয়েছেন হত্যা-নির্যাতন-সন্ত্রাস। চালিয়েছেন টেন্ডারে হস্তক্ষেপ ও চাঁদাবাজি। রাতারাতি হয়েছেন পাহাড়সম সম্পদের মালিক।
সাঈদী
জোট সরকারের পাঁচ বছরে পিরোজপুর-১ নির্বাচনী এলাকায় ৪৯৭টি কাবিখা-কাবিটা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব প্রকল্পে ৪ কোটি ৯৭ লাখ ৪৩ হাজার ১৫৫ টাকা ব্যয় করা হয়। এছাড়া টিআর প্রকল্পের আওতায় স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ-মন্দির, রাস্তা সংস্কার ও মাঠ ভরাটের নামে ১ হাজার ২৯৭টি প্রকল্পের ২ কোটি ৬ লাখ ৮৭০ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়। এসব প্রকল্পের নামমাত্র কাজ করে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ ও চাল গম আত্নসৎ করা হয়েছে। অনেক প্রকল্পের সঠিক কাগজপত্রও সংশ্লিষ্ঠ দফতরে নেই বলে জানা গেছে।
জোট সরকারের শাসনকালে সাঈদী ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে মাত্র তিনটি ইউনিয়নকে নিয়ে জিয়ানগর নামে নতুন উপজেলা গঠন করেন। তিনি প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে তার নিজ বাড়ি সাঈদখালী পর্যন্ত নির্মাণ করিয়েছেন বিশাল রাস্তা। বাড়ির সামনে তথাকথিত ‘সাঈদী বাজার’ নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করে তার পেছনে ব্যয় করেছেন ৬ লক্ষাধিক সরকারি টাকা। বাজারের বটবৃক্ষটি রক্ষণাবেক্ষণেই খরচ করেছেন ৪৫ হাজার টাকা।
গত পাঁচ বছরে সাঈদী প্রতিষ্ঠিত এসডি মদিনাতুল দাখিল মাদ্রাসা, সাঈদী ফাউন্ডেশন, পিরোজপুর ইসলামিয়া টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ, ভৈরমপুর ইসলামিয়া টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস কলেজ, তাফহিমুল কুরআন মাদ্রাসা, দরুল কুরআন মহিলা মাদ্রাসা, খলিশাখালী মহিলা মাদ্রাসা, নাজিরপুর দাখিল মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন মাদ্রাসা ও প্রতিষ্ঠানে অবৈধ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করেই তৈরি করেছেন বহু মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে বসিয়েছেন নিজেদের লোক।
অন্যদিকে নাজিরপুর কোষকাধী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শুসেন হালদারকে বরখাস্ত করে সেখানে নিয়োগ করা হয়েছে সাঈদীর পছন্দের ব্যক্তিকে। উপরন্তু অধ্যাপক শুসেনকে পুলিশি নির্যাতনের শিকার এবং মামলা দিয়ে এলাকাছাড়া করা হয়েছে।
সাঈদীর সুবাদে তার ভাই মোস্তফা সাঈদী ও ভাতিজা রুমী সাঈদীর ভয়ে তটস্থ থাকত বালিপাড়া, সাঈদখালী ও পত্তাসী এলাকার লোকজন। সাঈদখালীর চরে ছিল মোস্তফা সাঈদীর লাঠিয়াল বাহিনী। এছাড়া খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী এরশাদ সিকদারের সঙ্গে রুমি সাঈদীর সখ্য থাকার কারণে এলাকায় সে ছিল মূর্তিমান আতঙ্ক।
জোট সরকার ক্ষমতায় থাকায় পিরোজপুরে বিএনপি নেতাকর্মীদের চেয়েও বেশি লাভবান হয়েছে জামায়াত নেতাকর্মী এবং সাঈদীর আত্নীয়স্বজন। জেলা জামায়াতের সেত্রেক্রটারি মাওলানা শফিকুল ইসলাম মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। মাওলানা শফিকের ভয়ে তটস্থ থাকতে হতো বিভিন্ন দফতরের কর্তাব্যক্তিদের। নিজ নামে কোনো লাইসেন্স না থাকলেও সততা এন্টারপ্রাইজ, গালিব এন্টারপ্রাইজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সে এসব কাজ নেওয়া হতো।
পিরোজপুর বন বিভাগে চাকরিরত জামায়াত নেতা খন্দকার জাকির নামে-বেনামে ঠিকাদারি কাজ করে প্রচুর টাকার মালিক হয়েছেন। গত পাঁচ বছরে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এলাকায় পুলিশ প্রটোকল নিয়ে এবং সাইরেন বাজিয়ে চলাচল করতেন। ক্ষমতার মেয়াদপূর্তির পর তিনি এলাকায় এসে পুরোদমে নির্বাচনী কর্মকা- শুরু করেন। নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্রও জমা দেন। ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী প্রচারণা, গণসংযোগকালেও পুলিশ পরিবেষ্টিত হয়ে চলাফেরা করতেন। তবে জরুরি অধ্যাদেশ জারির পর তাকে আর এলাকায় দেখা যায়নি।
সাঈদী তার গ্রামের বাড়িতে কোনো বাড়ি বা সম্পদ না করলেও ঢাকায় তার পাঁচতলা বাড়িসহ বহু সম্পদ এবং তার ছেলেদের নামে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করেছেন।
কাশীনগরে সেনা পোশাক পরা এক ক্যাডার আওয়ামী লীগ কর্মীদের হাতে বোমাসহ ধরা পড়ে। উত্তেজিত জনতা তাকে পুলিশে তুলে দিলেও ক’দিন পরই সে মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে যায়।
২০০১-এর নির্বাচনে জয়লাভ তাহেরকে অপ্রতি্দ্বন্দী করে তোলে। শুরু হয় আওয়ামী লীগ নিধন ও বিএনপি তাড়াও অভিযান, টেন্ডার সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও জমি দখল। তার ছোট ভাই সৈয়দ একরামুল হক হারুন চৌদ্দগ্রামের ‘ছোট সাহেবে’ পরিণত হন। টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে গড়ে তোলা হয় ক্যাডার বাহিনী। এ চত্রেক্রর অপর দুই সদস্য ছিলেন মেশকাতউদ্দিন সেলিম ও উপজেলা জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক মোঃ শাহজাহান। তাদের নেতৃত্বে প্রতিটি ইউনিয়নে ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এ বাহিনীর অন্যরা হলেন বাচ্চু মেম্বার, হামিদা চোরা, রাসেল, রিপন, মমিন, মামুন, অলি আহম্মদ, আবু সায়েদ, আঃ আজিজ, বেলাল, জামাল, মহিন ডাইক, মোবারক, মিঠু ওরফে মিঠাইয়া চোরা, হানিফ, বাহার প্রমুখ।
উপজেলার কালুজুড়ি খালের ৩০ হেক্টর এলাকা থেকে বালু উত্তোলনের লিজ পেয়েছিলেন মেসার্স এমআর এন্টারপ্রাইজের মিজানুর রহমান। তাহেরের ক্যাডার গাজী আবু বকর, ইকবাল হোসেন কাজল, জাফর ইকবাল লিটন, খোকন ও জহির ঠিকাদারকে মারধর করে থানায় সোপর্দ করে এবং বালুমহালটি দখল করে রাখে। তার নিদরাউশে উপজেলা সদরের লক্ষ্মীপুর মৌজার দীঘিটি ২০০১ সালের ১১ অক্টোবর অবৈধভাবে দখল করে নেয় জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা। ওই দখল অভিযানে নেতৃত্ব দেয় জামায়াত ক্যাডার শাহাবউদ্দিন ও নূর ইসলাম। দীঘিটি জবরদখলের পর কুমিল্লা সার্কিট হাউসে এক সভায় সাবেক সাংসদ তাহের বলেছিলেন, ‘এখন থেকে আমি না বললে চৌদ্দগ্রামে কোনো পাতা নড়বে না।’
উপজেলার বাতিসা গ্রামের অসহায় মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার হোসেন ১৫ বছর ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গোবিন্দমানিক্য দীঘি লিজ নিয়ে মাছ চাষ করে আসছিলেন। পরে সড়ক ও জনপথ বিভাগের জায়গা লিজ নিয়ে একটি অস্থায়ী খাবার হোটেল খোলেন। জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই দীঘিটি দখল নিয়ে নেয় তাহেরের ক্যাডাররা। হোটেলটি দখল করার পর উল্লাসে মেতে রান্না করা খাবার রাস্তায় ছিটিয়ে আনন্দ করেছিল ক্যাডার বাহিনী।
শুধু তাই নয়, ১৯৫২ সালের দীঘির চন্দ্র নাগের দান করা বিদ্যালয়ের ৮ শতক জায়গাও জবরদখল করেন এ সাবেক সাংসদ। দখল করা জায়গায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইসলামী পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ সংস্থা’। চৌদ্দগ্রামের ঐতিহাসিক জগন্নাথ দীঘিও জবরদখল করে ভোগ করেন ওই সাবেক সাংসদ ও তার ক্যাডার বাহিনী।
২০০৩-এর ২৯ অক্টোবর জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা পল্লী বিদু্যতের ডিজিএমকে প্রকাশ্যে মারধর করে। এলাকার ডাকাত ও সড়ক ডাকাতরাও জোট সরকার আমলে জামায়াত-শিবির করেছে। চোরাকারবারিরাও তার দলে নাম লিখিয়েছিল। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের লালবাগ থেকে মোহাম্মদ আলী বাজার পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার সীমান্তর্বতী মহাসড়কে চোরাকারবারি ও সড়ক ডাকাতির মূল নেতা তাহেরের ছোট ভাই হারুন ওরফে ছোট সাহেব।
সাতকানিয়ার সম্রাট :
কালো নেকাব আর বোরকা ছাড়া সাতকানিয়ায় কোনো নারী ঘর থেকে বের হতে পারেন না। ‘বেপর্দা চলাফেরার’ ওপর অলিখিতভাবে এ ‘আইন’ চালু করেছিলেন চট্টগ্রামের জামায়াতি গডফাদার ও সাতকানিয়া আসনের সাবেক সাংসদ শাহজাহান চৌধুরী।
আপনার মতামত লিখুন