যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে সিরিয়ার সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ


দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সমগ্র সিরিয়া। যুদ্ধের ধ্বংসলীলা থেকে পুরোপুরি অক্ষত রয়েছে এমন কোনো নগর কিংবা গ্রামের খোঁজ পাওয়া যাবে না দেশটিতে। যুদ্ধের তাণ্ডবে পুরোপুরি বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে অসংখ্য গ্রাম এবং ছোট বড় শহর। এছাড়া রাক্কা কিংবা আলেপ্পোর মতো বড় শহরগুলোরও প্রায় পুরো মহল্লা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ট্যাংক, কামান কিংবা যুদ্ধবিমান থেকে ফেলা বোমায়।
প্রায় দেড় দশকের এ সংগ্রামের পর শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে সিরিয়ার মুক্তিকামী মানুষ। বিদ্রোহীরা উচ্ছেদ করতে সমর্থ হয়েছে দেশটির অর্ধশতাব্দীব্যাপী চলা একক পরিবারের স্বৈরশাসন। গত ৮ ডিসেম্বর বিদ্রোহীদের অগ্রাভিযানের মুখে রাজধানী দামেস্কে নিজের সুরক্ষিত বিলাসবহুল প্রাসাদ ছেড়ে সপরিবারে রাশিয়ায় পালিয়ে যান স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদ। এর মাধ্যমে অবসান হয় তার দুই যুগের নিপীড়নমূলক শাসনের।
তবে বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ার মানুষ নতুন করে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হলেও যুদ্ধে প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে দেশটির অর্থনীতি। ধ্বংস হয়ে গেছে অবকাঠামো থেকে শুরু করে সব ধরনের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ, পরিবহন এবং স্বাস্থ্যসেবা খাত প্রায় পুরোপুরি ধসে পড়েছে।

চৌদ্দ বছরের অব্যাহত সংঘাতে দেশ ছেড়েছে প্রায় ৫০ লাখ সিরীয় মানুষ, যা দেশটির সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় ২০ ভাগ। পাশাপাশি ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর দি কোঅর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাফেয়ার্স বা ওসিএইচএর দেয়া তথ্যমতে, যুদ্ধের কবলে পড়ে দেশের মধ্যেই বাস্তুচ্যুত অবস্থায় রয়েছেন আরও প্রায় ৭০ লাখ সিরীয়।
যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত সিরিয়া ছিল মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সমৃদ্ধ দেশ। দেশটির অর্থনীতির প্রধান দুই ভিত্তি ছিল তেল সম্পদ ও কৃষি উৎপাদন। সিরীয় সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস ছিল তেল উত্তোলন। পাশাপাশি কৃষি ছিল জিডিপির মূল ভিত্তি। তবে প্রায় দেড় দশকের যুদ্ধে বর্তমানে তেল শিল্প ও কৃষি উৎপাদন দুই খাতই বিধ্বস্তপ্রায়। যুদ্ধের শুরুতেই বাশার আল-আসাদের সরকার নিয়ন্ত্রণ হারায় সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় অবস্থিত তেল ক্ষেত্রগুলো থেকে।
অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, যুদ্ধের ক্ষতি সহসাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না সিরীয়বাসীর জন্য। সিরিয়ার পুনর্গঠনে লেগে যেতে পারে আরও প্রায় এক দশক। এক গবেষণায় দেখা গেছে সিরিয়ার জিডিপি ২০১১ সালের যুদ্ধ পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে নিতেও সময় লাগবে আরও দশ বছর। পাশাপাশি বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ায় ঘনীভূত হওয়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেশটির অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেক বিশ্লেষকই।
সিরিয়ার অর্থনীতি পুনর্গঠনের পথে আরও একটি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাব। কারণ যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার পুনর্গঠনে প্রয়োজন হবে বিপুল পরিমাণ অর্থের। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসলে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়বে দেশটির জন্য।
২০১৯ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার পুনর্গঠনে তখনই প্রয়োজন ছিল প্রায় ৪শ বিলিয়ন ডলার। এর পরে যুদ্ধে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটি। ফলে সিরিয়া পুনর্গঠনের বর্তমান খরচ বেড়ে দাঁড়াবে অনেক বেশি। পাশাপাশি নিজ দেশের জনগণের ওপর নির্যাতন, গণহত্যা এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে সাবেক শাসক বাশার আল-আসাদের সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব। বাশার আল-আসাদ বিদায় হলেও পশ্চিমা বিশ্ব এ নিষেধাজ্ঞা তুলবে কি না সে ব্যাপারেও রয়েছে অস্পষ্টতা।
এ পরিস্থিতিতে বাশার আল-আসাদ পরবর্তী সময়ে সিরিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্বে যারা থাকবেন তাদের সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটি দিতে হবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই। বাশার আল-আসাদের পতনের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই তুরস্কসহ প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়া সিরীয় শরণার্থীরা দলে দলে দেশে ফিরতে শুরু করেছেন। পাশাপাশি যুদ্ধের কারণে নিজের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে বিভিন্ন আশ্রয় শিবির কিংবা দেশের ভেতরেই অন্যত্র আশ্রয় নেয়া সিরীয়রা নিজ নিজ ঘরবাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন।
আপনার মতামত লিখুন