সিলেটে ‘গায়েবি’ মামলায় আসামি প্রবাসী,


সিলেটের শাহপরানের পিরেরচক এলাকার মনোয়ার জাহান চৌধুরী তিন বছর ধরে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে সপরিবারে বসবাস করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর সশরীরে হামলার অভিযোগ এনে সম্প্রতি সিলেটের আদালতে মামলার আবেদন করেছেন শেখ শফিউর রহমান কায়েছ নামের একজন। আদালত অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সিলেট মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দিয়েছেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আদালতের পেশকার মিজান। ১২ মার্চ মামলার আবেদনটি করেন শেখ শফিউর রহমান কায়েছ। এই মামলায় শুধু প্রবাসী মনোয়ার জাহান চৌধুরীই নন, বিএনপি-জামায়াত ঘরানার অনেককে এবং সিলেটে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে কর্মরত প্রকৌশলীসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও আসামি করা হয়েছে।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, আসামিরা গত বছরের ১৮ জুলাই বিকেলে সিলেট নগরের মদিনা মার্কেট পয়েন্ট এলাকায় ছাত্র-জনতার মিছিলে হকিস্টিক, চাপাতি, দা ও রামদা দিয়ে হামলায় অংশ নেন। মামলায় ১৩৫ জনের নাম উল্লেখ ছাড়াও অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে ১০০-১৫০ জনকে।
শেখ শফিউর রহমান কায়েছ সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার রণকেলী উত্তর গ্রামের শেখ আব্দুর রহমান জনির ছেলে। বর্তমানে তিনি সিলেট নগরের আখালিয়া এলাকায় বসবাস করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, মামলায় ৩২ নম্বর আসামি এলজিইডি সিলেটের সহকারী প্রকৌশলী (পুর) আবুল হাসান শোভন, ৪৮ নম্বর আসামি সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন, ৫২ নম্বর আসামি পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস, ৬০ নম্বর আসামি এলজিইডি সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী কে এম ফারুক হোসেন, ৭০ নম্বর আসামি স্বাস্থ্য প্রকৌশল সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুর রহমান, ৭১ নম্বর আসামি গোলাপগঞ্জ উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার মাহমুদুল হাসান, ৭৮ নম্বর আসামি জোনাল সেটেলমেন্ট অফিস সিলেটের উপসহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার গোলাম মোস্তফা লিটন এবং ৮৬ নম্বর আসামি অবসরপ্রাপ্ত সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার আব্দুল হাই আজাদ। ৬৪ নম্বর আসামি সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান।
বাদীর দাবি, ঘটনার সময় ও তারিখে সব আসামি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাংবাদিক মনোয়ার জাহান চৌধুরী বলেন, ‘ছাত্র বা পেশাগত জীবনে কখনো কোনো রাজনীতি করিনি। দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করায় সিলেট শহরের মানুষ আমাকে চেনে। কারও সঙ্গে শত্রুতাও নেই। বিষয়টি শুনে হতভম্ব হয়েছি। মনে মনে দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এখন চিন্তায় পড়ে গেলাম।’
অভিযোগ অস্বীকার করে সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, ‘কয়েক দিন আগে একজন উকিল এসে ধমকিয়ে গেছে ১৩ ফুট রাস্তার মধ্যে ছয়তলা বিল্ডিং অনুমোদনের জন্য। না দেওয়ায় মামলা দিয়েছে।’ বাকি সরকারি কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীরা মামলার বিষয়ে জানেনই না।
নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস, কে এম ফারুক হোসেন, শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কেন মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে আসামি করা হবে?’
এদিকে মামলার আবেদনে দেওয়া মোবাইল নম্বরটি আদালতে দাখিলের পরদিন থেকেই বন্ধ রয়েছে। আদালতে দেওয়া জন্মনিবন্ধন নম্বর অনুযায়ী ২১ আগস্ট ২০০৮ সালে বাদী শেখ শফিউর রহমান কায়েছের জন্ম।
বাদীর আইনজীবী শামছুল আলম দুস্কি বলেন, ‘মামলা করতে কোনো বয়স লাগে না। এনআইডি দিয়ে মামলা করেছে।’ প্রবাসী সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের আসামি করার বিষয়ে জানতে চাইলে এই আইনজীবী বলেন, ‘এগুলো একান্ত বাদীর বিষয়। তাঁর অনুমতি ছাড়া বলতে পারব না।’
এদিকে অনেক খোঁজাখুঁজির পর বাদীর বাবা শেখ আব্দুর রহমান জনির সন্ধান পাওয়া যায়। গত বুধবার বিকেল ৪টায় ওসমানী মেডিকেল রোডের মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেসের নিচতলায় গিয়ে মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ক্ষিপ্ত হন। নিজেকে ‘যুবদলকর্মী’ পরিচয় দিয়ে তিনি দাবি করেন, জন্মনিবন্ধনে তাঁর ছেলের বয়স কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আসলে তাঁর বয়স ২১ বছর। ২০০৫ সালে জন্ম। মামলার বিষয়ে তিনি শুনেছেন, তবে কাদের আসামি করা হয়েছে তা জানেন না। তিনি বলেন, ‘সে মামলা করছে, তার সংগঠনে করাইছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এরা করাইছে।’
পরে মামলার বাদী শেখ শফিউর রহমান কায়েছের অন্য আরেকটি মোবাইল নম্বর দেন তাঁর বাবা। ওই নম্বরে যোগাযোগ করলে শেখ শফিউর রহমান কায়েছ বলেন, ‘আমি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সেন্ট্রাল থেকে মামলা করছি। আমি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সিলেট মহানগরের কর্মী।’ মামলার আসামিদের বিষয়ে জানতে চাইলে কায়েছ বলেন, ‘আমার সাক্ষীরা এসব নাম সংগ্রহ করে দিয়েছে।’
তবে মামলার তিন সাক্ষী রেজাউল ইসলাম নাহিদ, শাহাদাত হোসেন, সাজন আহমদ সাজু বলেন, ‘১৮ জুলাই আমরা আন্দোলনে ছিলাম, আহত হইনি। আমরা ৪ আগস্ট গুরুতর আহত হই। শেখ শফিউর রহমান কায়েছ নামের কাউকে চিনি না। এই মামলা বা ঘটনার বিষয়েও আমরা জানি না।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সিলেট মহানগরের আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসাইন বলেন, ‘শেখ শফিউর রহমান কায়েছ নামে আমাদের কর্মী আছে। তবে এই মামলার ব্যাপারে অবগত না। সে এটি ভালো বলতে পারবে।’
সিলেট মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জিয়াউল হক বিকেলে বলেন, ‘বিষয়টি শুনেছি, তবে আদালত থেকে এখনো নথিপত্র আমাদের কাছে আসেনি। আসলে নির্দেশনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেব।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এটি একটি জঘন্য ঘটনা। আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন, কারও ওপর এমন মামলা হবে না। কাউকে হয়রানি করা হবে না। এটা বাজে রেকর্ড হয়ে থাকবে। সরকার এর দায় এড়াতে পারে না। আমরা মনে করি এটি একটি হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে।’
আপনার মতামত লিখুন