বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতার পটপরিবর্তনে সাথে সাথে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুদের নিরাপত্তার বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে।
গত চার দশকের রাজনীতিতে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে পরাজিত হবার পর কিংবা ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ সামনে এসেছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক এবং বিভিন্ন হিন্দু সংগঠনের নেতারা বলছেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর প্রথম বড় আকারে হামলার ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯২ সালে, ভারতে বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে দেবার সময়।

তখন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় ছিল। এরপর হিন্দুদের ওপর বড় আকারে হামলার ঘটনা ঘটে ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হবার পরে।

নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করার পরপরই দেশের বেশ কিছু জেলায় হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হয়। যদিও তখন ক্ষমতায় ছিল বিচারপতি লতিফুর রহমানে নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
নির্বাচনে ফলাফল প্রকাশের দিন থেকে শুরু করে বিএনপি ক্ষমতা গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ে বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটে। এছাড়া বিএনপি ক্ষমতা গ্রহণ করার পরেও বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল।
এসবের পেছনে বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল।
সর্বশেষ হিন্দুদের ওপর হামলার অভিযোগ আসে গত ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাবার পরে।

কত হামলা হয়েছে?

হিন্দুদের একটি সংগঠন জাতীয় হিন্দু মহাজোট এক পরিসংখ্যানে মাধ্যমে দাবি করেছেন, শেখ হাসিনার পতনের পরে ৪৮টি জেলায় ২৭৮টি হামলার ঘটনা ঘটেছে।
অন্যদিকে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নামে আরেকটি সংগঠন দাবি করছে, ৫২টি জেলায় অন্তত ২০৫টি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ও উপাসনালয়ে হামলার ঘটনা তদন্তে ‘সংখ্যালঘু কমিশন’ গঠনের দাবি জানিয়েছে ‘সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলন’ নামের একটি সংগঠন।

তবে এসব সংগঠন যেসব দাবি করছে সেগুলোর সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।তবে এই সব কয়টি ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে হামলা হয়েছে, আর কতটা সরকার ঘনিষ্টদের ওপর ক্ষোভের অংশ হিসেবে হামলা হয়েছে, তা নিরপেক্ষভাবে যাচাই সম্ভব হয়নি।

ফ্রিডম সিলেট যাচাই বিভাগ ভেরিফাই এবং গ্লোবাল ডিসইনফরমেশন টিম সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পোস্টের অনেকগুলো যাচাই করে দেখেছে, যাতে দেখা গেছে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি অনেক হামলার গুজবও ছড়ানো হয়েছে।

হিন্দুদের আতঙ্ক কেন?
শেখ হাসিনার পতন ও পালিয়ে যাবার পরে কতগুলো হামলার ঘটনা ঘটেছে সেটি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুরা যে ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশে বসবাস করছে, সেটি লক্ষ্য করা যায়।

রানা দাশগুপ্ত মনে করেন, হিন্দু ওপর হামলার ক্ষেত্রে এক ধরণের দায়মুক্তির সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে। এসব হামলার সাথে যারা জড়িত ছিল অতীতে তাদের বিচার কখনো হয়নি। ফলে এটি থামানো যাচ্ছে না।
“তারাই হিন্দুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যারা ধর্মীয় সহাবস্থানে বিশ্বাস করেন না।” তিনি বলেন এই ধারা পাকিস্তান আমল থেকে চলে আসছে।

ভারত, হিন্দু এবং আওয়ামী লীগ – এ তিনটি বিষয়কে একটি রেখায় চিন্তা করা হয়। এ বিষয়টি অস্বীকার করছেন না রানা দাশ গুপ্ত।

মি. গুপ্ত স্বীকার করছেন, গত ১৫ বছর যাবত আওয়ামী লীগ সরকারি চাকরিতে নিয়োগ ও পদন্নোতির ক্ষেত্রে ‘অতীতের বৈষম্য’ দূর করার চেষ্টা করেছে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অনুপাত মোট জনসংখ্যার আট শতাংশ। কিন্তু সে অনুপাতে নিয়োগ ও পদোন্নতি হয়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
“যখন সংখ্যালঘুদের দেখা গেল, তখন আবার চিৎকার শুরু করলো যে সংখ্যালঘুরা তো সব খেয়ে ফেলছে”

তিনি বলেন, হিন্দুরা কখনো ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করতে পারে না।

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজের অধ্যাপক মুশতাক খান  বলেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হলে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় আওয়ামী লীগ ও ভারত।

“আওয়ামী লীগের অনেক লোকের ওপর আক্রমণ হয়েছে এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে হিন্দুদের ভালো রিপ্রেজেন্টেশন আছে। ”

কিন্তু এসব কথা মানতে নারাজ বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা রানা দাশ গুপ্ত। তিনি বলেন, এবার হিন্দুদের ওপর যেসব হামলা হয়েছে সেগুলোর সাম্প্রদায়িক মাত্রা রয়েছে।

তিনি বলেন, বিষয়টিকে শুধু রাজনৈতিক মাত্রা দেবার সুযোগ নেই।
অ্যাবসলিউট মিথ্যা কথা। চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি কি আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন? তাহলে তার বাড়ি কেন গুড়িয়ে দেয়া হলো?” প্রশ্ন তোলেন রানা দাশ গুপ্ত।